চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) বন্ধ রয়েছে টানা দেড় মাস ধরে। এ কারণে গুরুতর অসুস্থ রোগীদের ভর্তি নেওয়া যাচ্ছে না হাসপাতালে। জরুরি মুহূর্তে আইসিইউ শয্যা না পেয়ে ঝুঁকির মুখে পড়ছে অনেকের জীবন। সংশ্লিষ্ট বিভাগে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হলেও সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ২৫০ শয্যার অনুমোদন থাকলেও চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা চালানো হচ্ছে মাত্র ১৫০ শয্যার উপযোগী জনবল দিয়ে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই হাসপাতালে কোনো আইসিইউ শয্যা ছিল না। করোনা মহামারির সময় ২০২০ সালে ১৮টি আইসিইউ শয্যা স্থাপন করা হয়, যখন এই হাসপাতালকে কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড ঘোষণা করা হয়েছিল।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে হাসপাতালের জন্য বরাদ্দ ২২টি ভেন্টিলেটরের মধ্যে ২০টি নষ্ট হয়ে গেছে। বাকি দুটি থাকলেও সেগুলোর কার্যক্ষমতা কমে গেছে, ফলে প্রতিটি ভেন্টিলেটর ২৪ ঘণ্টা পরপর পরিবর্তন করতে হচ্ছে। ৩৩টি বাইপ্যাপ মেশিনের মধ্যে ২৮টি অকার্যকর এবং ৩৯টি হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানুলার মধ্যে ৩৬টিই অচল।
সিনিয়র কনসালট্যান্ট না থাকায় এবং মাত্র দু’জন জুনিয়র কনসালট্যান্টের ওপর দায়িত্ব পড়ায়, তাঁরা বাধ্য হয়ে অন্য বিভাগেও সেবা দিতে হয়। পুরো বিভাগের জন্য মাত্র একজন মেডিকেল অফিসার রয়েছেন, যিনি এককভাবে পুরো ইউনিট সামাল দিতে পারছেন না।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সমস্যার সমাধানে গত ছয় মাসে পাঁচবার সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি দিয়েছে। সর্বশেষ চিঠি পাঠানো হয় ২০২৫ সালের ২৬ এপ্রিল। এর আগে ৬ এপ্রিল, ২৭ মার্চ, ২৩ ফেব্রুয়ারি এবং ২০২৪ সালের ১৭ নভেম্বর চিঠি পাঠানো হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, বিভাগীয় পরিচালকসহ বিভিন্ন দপ্তরে চিঠির অনুলিপি পাঠানো হলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, আইসিইউ চালু রাখতে প্রয়োজন অন্তত তিনজন কনসালট্যান্ট, ছয়জন মেডিকেল অফিসার এবং প্রশিক্ষিত চিকিৎসক। বর্তমানে ২৪ চিকিৎসকের সংযুক্তি বাতিল হওয়ায় আইসিইউ বিভাগে সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
গতকাল সোমবার সরেজমিনে দেখা যায়, আইসিইউ বিভাগটি দুই কক্ষে বিভক্ত—একটিতে ১০টি এবং অন্যটিতে ৮টি শয্যা। একটি কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করলে দেখা যায় ঘুটঘুটে অন্ধকার, নেই কোনো আলোর ব্যবস্থা, এমনকি ফ্যানও বন্ধ। কক্ষটি অধিকাংশ সময়ই বন্ধ থাকে।
অনুরোধে প্রতিবেদক যখন কক্ষে প্রবেশ করেন এবং কিছু লাইট চালানো হয়, তখন দেখা যায়, সারিবদ্ধভাবে রাখা আটটি শয্যার প্রতিটিই অচল। ভেন্টিলেটর, মনিটর, বাইপ্যাপ মেশিন, হাই ফ্লো ক্যানুলা সহ কোনো প্রয়োজনীয় সরঞ্জামই নেই। অনেক শয্যার চাকা ভাঙা, কোনোটির স্ক্রু খোলা, কোনোটা আবার রশি দিয়ে বাঁধা। যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে পড়ে আছে চারপাশে। পুরো কক্ষেই ছড়িয়ে আছে ধুলো, ময়লা ও জংধরা যন্ত্রাংশ।
আইসিইউ বন্ধ থাকায় জরুরি সেবা চালানো হচ্ছে হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ) দিয়ে। তবে এটিও সীমিত এবং কার্যক্ষমতা কম। বর্তমানে মাত্র দুটি শয্যায় রোগী ভর্তি রয়েছে, বাকিগুলো অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। গতকালও কয়েকজন মুমূর্ষু রোগী আসলেও ভর্তি না হতে পেরে ফিরে যান।
আইসিইউ বিভাগের দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক ডা. মৌমিতা দাশ বলেন, ‘লাইফ সাপোর্ট প্রয়োজন এমন রোগী এলেও ভর্তি নেওয়া যাচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়ে রেফার করতে হচ্ছে। এতে রোগীর পরিবার যেমন বিপাকে পড়ছে, আমরাও বিব্রত।’
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আবদুল মান্নান জানান, কিছুদিন আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি দল আইসিইউ পরিদর্শন করলেও কোনো অগ্রগতি হয়নি। তিনি জানান, আইসিইউ চালু করতে দ্রুত পদক্ষেপ প্রয়োজন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী বলেন, ‘চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল সরকারিভাবে দ্বিতীয় বৃহত্তম হাসপাতাল। প্রতিদিন বহু মুমূর্ষু রোগীর জন্য আইসিইউ দরকার হয়। অথচ যে কয়টি শয্যা রয়েছে, তাও বন্ধ পড়ে আছে। এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।’
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ডা. মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান সম্প্রতি হাসপাতাল পরিদর্শনে এলেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমরা অত্যন্ত বিব্রত। বিষয়টি একাধিকবার জানানো হয়েছে, কিন্তু এখনও কার্যকর পদক্ষেপ নেই।’
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের এমন করুণ অবস্থা চট্টগ্রামবাসীর জন্য এক গভীর উদ্বেগের বিষয়। রোগীদের জীবন রক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া না হলে যে কোনো সময় বড় বিপর্যয় ঘটতে পারে। প্রয়োজন জরুরি ভিত্তিতে যন্ত্রপাতি মেরামত, জনবল নিয়োগ এবং আইসিইউ সেবা পুনরায় চালু করা।
তথ্যসূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ
রুইট নিউজ ২৪ ঘণ্টা বাংলার খবর