কুড়িগ্রামের এক প্রত্যন্ত চরের ছেলে তানিম আহমেদ সদ্য নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় বড় ভাইয়ের ফোন দেখে আগ্রহ জন্মায় তার। শিক্ষিত বাবা-মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে একটি এন্ড্রয়েড ফোন কিনে নেয় শখের বসে। বাবা-মাও চেয়েছিলেন তাদের সন্তান আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইন্টারনেট জগৎ সম্পর্কে ধারণা পাক। সেই স্বপ্ন এখন যেন দুঃস্বপ্নে রূপ নিয়েছে।
নদী চরের বাড়িতে হঠাৎ বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়ায় খুশির সীমা ছিল না তানিমের। আর সৌরবিদ্যুতে ফোন চার্জ দেওয়ার কষ্টও নেই। শুরু হয় ছবি তোলা, ভিডিও করা—এভাবেই প্রযুক্তি হাতে খেলা শুরু। কিছুদিনের মধ্যে বন্ধুদের দেখাদেখি একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলে সে। নিজের ছবি পোস্ট করে লাইক-কমেন্টস দেখে খুশি হয়ে যায়।
সমস্যা তখনই শুরু হয়, যখন এমবি কেনার জন্য বাবার কাছ থেকে টাকা নিতে হয়। প্রায়ই নানা কৌশলে মোবাইল রিচার্জের জন্য টাকা আদায় করে। এতে খরচ বাড়ে বাবা-মায়ের। এরপর এলাকায় আসে ওয়াইফাই সংযোগ। জোর করে মোটা অংকের টাকা নিয়ে বাসায় সংযোগ স্থাপন করে তানিম। এবার অনবরত ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগে সে ডুবে যায় ভার্চুয়াল জগতে।
ইতোমধ্যে ফেসবুকের পাশাপাশি গেমসের প্রতিও আসক্ত হয়ে পড়ে সে। সকাল-সন্ধ্যা পড়তে বসা ছেলেটি এখন মোবাইল ছাড়া কিছুই বোঝে না। রাত জেগে গেমস খেলায় শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে সে। এক সময় বাধ্য হয়ে তাকে চিকিৎসকের কাছে নিতে হয়।
তানিম যেন কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলের অগণিত উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েদের প্রতিনিধি। একসময় যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাত্রছাত্রীদের কোলাহলে মুখর থাকতো, এখন সেখানে নীরবতা। বিকেলের মাঠে ফুটবল-ক্রিকেট তো দূরে থাক, দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, বউচির মতো দেশীয় খেলাধুলাও হারিয়ে গেছে অনেক আগেই।
মাঠগুলোতে এখন আগাছা আর ধুলাবালি। স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি যেমন কমেছে, তেমনি পড়ালেখার পরিবেশও অনেকটা বিলুপ্তপ্রায়। মোবাইল ফোন যেন ছেলেমেয়েদের হাতে ‘ডিজিটাল বিষ’ হয়ে উঠেছে।
কোদালকাটি চরের বাসিন্দা রিপন আহমেদ বলেন, “ছোটবেলায় আমরা স্কুলে পড়ালেখা করতাম আর বিকেল হলেই মাঠে খেলতে যেতাম। এখনকার যুগের ছেলেমেয়েরা পড়ালেখাও করেনা খেলাধুলাও করেনা। পড়লেখা না করলে মানুষ হবে কীভাবে?”
তিনি আরও বলেন, “খেলাধুলা তো শরীর ও মন ভালো রাখার জন্য অপরিহার্য। অথচ এসব কিছু এখন ভুলতে বসেছে নতুন প্রজন্ম।”
কোমরভাঙ্গী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আব্দুস সালাম জানান, “ছেলেমেয়েরা আগের মতো স্কুলে আসেনা। যারা আসে, তারা মনোযোগ দেয়না পড়াশোনায়। বেশিরভাগ সময়ই মোবাইলে ফেসবুক আর গেমস নিয়ে ব্যস্ত থাকে।”
তিনি আরও বলেন, “বিদ্যালয়ে মাঠ থাকলেও কেউ খেলাধুলা করেনা। সেই সময়গুলো মোবাইলে নষ্ট করে দিচ্ছে তারা।”
মোবাইলের ক্ষতিকর দিক নিয়ে কথা বলেছেন ডা. মো. কেরামত আলী। তিনি বলেন, “উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা যদি মোবাইলের ডিসপ্লের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকে, তবে তাদের চোখের রেটিনা ও কর্নিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এ ছাড়া হতে পারে ক্ষুধামন্দা, মাথা ব্যথা, হাত ও পিঠে ব্যথা।”
তিনি আরও জানান, “মোবাইলের অতিরিক্ত ব্যবহারে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, পড়ালেখায় অমনোযোগী হয়ে পড়ে এবং স্মরণশক্তি লোপ পেতে থাকে।”
মোবাইল ফোন একদিকে যেমন আধুনিক প্রযুক্তির দ্বার উন্মোচন করেছে, অন্যদিকে এটি উঠতি প্রজন্মের কাছে এক ধরনের নেশায় পরিণত হয়েছে। প্রয়োজন এখনই সচেতনতা, পরিবার ও শিক্ষকদের সমন্বয়ে মোবাইল ব্যবহারের উপর যৌক্তিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা।
রুইট নিউজ ২৪ ঘণ্টা বাংলার খবর